গীবত কি,গীবতের প্রকারভেদ,গীবত সম্পর্কে কুরআনের আয়াত,গীবত সম্পর্কে হাদিস,গীবত কোন ক্ষেত্রে করা জায়েজ
গীবত
গীবত কি?
গীবত আরবি শব্দ।অন্যের দোষ চর্চা বা অনুসন্ধান করাই হল গীবত।এটি কবীরা গুনাহ এবং হারাম কাজের মধ্যে অন্যতম।
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় গীবতের অর্থ হল মুখে,কলমে,অন্য যে কোন উপায়ে কারো অনুপস্থিতিতে সে ব্যক্তির এমন কোন দোষ এর কথা আলোচনা করা যা শুনলে সে ব্যক্তি মনে প্রানে দুঃখ পাবে।যা শুনলে সে ব্যক্তি রাগান্বিত হবে।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন,
তোমরা একে অন্যের গীবত চর্চা করবে না।তোমাদের কেউ কি চায় সে তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাবে।বস্তুত তোমরা কখনো তেমন করবে না অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।নিশ্চয় তিনি তওবা গ্রহনকারী ও অত্যন্ত দয়ালু।সূরা হুযুরাত :১২
সচরাচর কাউকে যখন অন্যের গীবত করা থেকে নিষেধ করা হয় তখন সে বলে আমি হুবহু এ কথা তার সামনেও বলতে পারব।একথা বলতে যেয়ে আমি তাকে এতটুকু ও ভয় পাব না।তবে এটিও গীবত বলে গণ্য হবে।
গীবত সম্পর্কে হাদিস
একবার কোন প্রয়োজনে এক মহিলা সাহাবি রসুল সাঃ এর কাছে এসেছিলেন।হযরত আয়েশা রাঃ তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।প্রয়োজন শেষ এ ওই মহিলা বিদায় নিলে আয়েশা রাঃ সরলচিত্তে বলেন - ইয়া রসুলুল্লাহ! এ মহিলাটি বেঁটে আকৃতির নয় কি? হযরত আয়েশা রাঃ এ কথা বলাতে রাসুল সাঃ অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে বললেন - হে আয়েশা তুমি অনর্থক এ মহিলার গীবত করলে কেন?হযরত আয়েশা রাঃ তখন অবাক হয়ে বললেন - ইয়া রসুলুল্লাহ আমি অসত্য কোন কিছুই ওই মহিলারা সম্বন্ধে বলি নি।তখন রসুল সাঃ বললেন - তুমি অসত্য কোন কিছুই বল নি তবে তুমি ওই মহিলার অগোচরে তার শারীরিক ত্রুটি সম্পর্কে সমালোচনা করেছ।
হযরত আনাস রাযি. বলেন রসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন ঃ যখন মে'রাজের সময় আমাকে আসমানে তুলে নেয়া হয় তখন আমি একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করি যাদের নখ ছিল তামার,তারা নিজেদের নখ দ্বারা নিজেদের চেহারা ও সীনা খামছে খামছে ছিঁড়ছিল।আমি হযরত জিবরাইল আঃ কে জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা? তিনি বললেন " এরা ওই সমস্ত লোক যারা মানুষের গোস্ত খেত অর্থাৎ গীবত করত"।
যারা গীবত করে তাদের দোয়া কবুল হয় না।
আবার যার গীবত করা হয় তার আমলনামায় গীবতকারীর সওয়াব চলে যায় এবং তার গোনাহ গীবতকারীর আমলনামায় চলে আসে।
হযরত হাছান বসরী রহ. যার নাম হয়তো আমরা অনেকেই শুনেছি।যিনি অনেক বড় বুজুর্গ ছিলেন।তিনি কখনও যদি শুনতেন যে অমুক তার গীবত করেছে,তাহলে তার কাছে প্লেট ভরে ফল মিষ্টি হাদিয়া পাঠিয়ে দিতেন।তিনি বলতেন,মাশাআল্লাহ তিনি আমার অনেক উপকার করেছেন,এতো কষ্ট করে সাওয়াব অর্জন করে আমাকে দিয়ে দিয়েছেন।তাই তার উদ্দেশ্যে মিষ্টি পাঠাতেন।
আমরা অনেকেই মনে কি শুধু স্বভাব চরিত্রের দোষ প্রকাশ করা গীবত।কিন্তু আসলে তা নয়।জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক,পোশাক-পরিচ্ছদ, শারীরিক গঠন,বংশ ইত্যাদির যেকোন বিষয়ে দোষ বর্ণনা করায় গীবত। গীবত যেমন জীবিত মানুষের হয় তেমন মৃত মানুষেরও হয়।কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে শুধু ভাব ভঙ্গিমায় তার দোষ বর্ণনা করাও গীবত।এমনকি কু-ধারনা পোষনও গীবত।এটা হচ্ছে অন্তরের গীবত।
গীবতের বৈধ পন্থা
- অন্যায় ও যুলুমের বিপক্ষে আবেদন করা।
- ইসলাম বিরোধি কার্যকলাপ বন্ধে ও সৎ কাজের মাধ্যমে পাপ কাজ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কিছু বলা।
- কোন বিষয়ে ফতওয়া চাওয়া।মুফতি সাহেবের কাছে গিয়ে বলা যে আমার অমুক আত্নীয় আমার উপর জুলুম করছে।এ থেকে বাচার উপায় কি।এগুলো বলা জায়েয।
- কোন ব্যক্তি প্রকাশ্যে ফাসেকী ও বিদয়াতি কাজ করে তার ব্যাপারে আলোকপাত করা যাবে।কিন্তু তার কৃত কু-কাজ ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করা বৈধ নয়।
- পরিচয় দেয়া,কোন ব্যক্তিকে তার বিশেষ উপাধি বা তার কোন দৈহিক ত্রুটি বর্ণনা করে পরিচয় দেয়া বৈধ।তবে তাকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যে এমন করা অনুচিত এবং হারাম।এসব ত্রুটির বর্ণনা ছাড়া অন্যভাবে পরিচয় দিতে পারলে সেটাই উত্তম।
গীবত করা এত মারাত্মক গুনাহ,অথচ আমরা এটকে গুনাহই মনে করি না।আমাদের কোন মজলিস গীবত থেকে খালি যায় না।দুই চারজন একসাথে বসে কথা শুরু করলেই ব্যস,গীবত শুরু হয়ে যায়।খুব মজা করেই গীবত করতে থাকি।একজন মন্তব্য করেছেন গীবত যেন এখন ঘি-ভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।অর্থাৎ ঘি-ভাত যেরকম মজা লাগে, গীবত করতেও আমাদের ওই রকম মজা লাগে।
গীবতকে যেন আমরা গোনাহ মনেই করছি না।অথচ গোনাহকে গোনহ মনে না করা মারাত্মক গোনাহ।কোন গোনাহকে গোনাহ মনে করার সত্ত্বেও যদি কেও গোনাহ করে,তাহলে একদিন সে গোনহের জন্য তওবা করে নিতে পারে,তার মনের ভেতর সে গোনাহের জন্য অনুশোচনা আসতে পারে।
কিন্তু কোন গোনাহকে যদি কেউ গোনাহ মনেই না করে,তাহলে সেই গোনাহের জন্য তার মনে কোন দিন অনুশোচনা হয় না।ফলে ওই গোনাহ থেকে কোন দিন তার তওবা করাও হয়ে উঠে না।ঐ পাপ নিয়েই সে কবরে চলে যায়।এ কারনে গোনাহকে গোনাহ মনে না করা মারাত্মক ব্যাপার।
নিজে গীবত করলে যেমন গোনাহ হয় তেমনি সেচ্ছায় বা মনোযোগ সহকারে গীবত শুনলেও গীবতের গোনাহ হয়।
কাউকে গীবত করতে শুনলে তাকে বাঁধা দেওয়া উচিত।না পারলে সেই মজলিশ ত্যাগ করতে হবে।যদি সে মজলিশ ত্যাগ করা সম্ভব না হয়,তবে গীবত শোনা থেকে মনোযোগ হটিয়ে মনে মনে অন্য কিছু ভাবা শুরু করতে হবে বা মনে মনে জিকির আযগারে লিপ্ত হতে হবে।তাহলে গীবত শোনার গোনাহ থেকে মুক্ত হতে পারব।
যদি কারো গীবত শোনা হয়ে যায়,কারও গীবত নিজের কানে আসে,তাহলে সে গীবত শোনার পর নিম্নোক্ত কাজ করা উচিৎ -
- এ শোনা কথা অন্যের কাছে বর্ণনা না করা।
- যার দোষ শোনা হল তার দোষ খুঁজতে না শুরু করা।
- যার দোষ শোনা হল তার উপর বদ গোমানী না করা।
- পারলে গীবতকারীর গীবতের অভ্যাস পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিতে হবে
- বেশি প্রয়োজন হলে আসল ব্যক্তির কাছ থেকে জেনে নেয়া যেতে পারে সে সত্যটা কি।তবে তাহকিক করতে গিয়ে গীবতকারীর নাম উল্লেখ করা উচিৎ নয়।তাতে ফ্যাসাদ বাড়বে।
যদি কেও নফসের ধোঁকায় পড়ে গীবত করে বসে তাহলে নিজে ইস্তেগফার পড়ে নিবে।যার গীবত করা হয়েছে তার জন্যেও ইস্তেগফার পড়ে নিতে হবে।আর গীবত করা ব্যক্তির যে মান সম্মানের ক্ষতি হয়েছে তার জন্য যাদের সামনে গীবত করা হয়েছে তাদের সামনে সেই লোকের প্রশংসা করতে হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন